নিজস্ব প্রতিবেদক
“নাই কিরে সুখ? নাই কিরে সুখ?
এ ধরা কি শুধু বিষাদময়?
যতনে জ্বলিয়া কাঁদিয়া মরিতে
কেবলি কি নর জনম লয়?
“এরা সুখের লাগি চাহে প্রেম,
প্রেম মেলে না, শুধু সুখ চলে যায়।
এমনি মায়ার ছলনা।”
পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি,
এ জীবন মন সকলি দাও,
তার মতো সুখ কোথাও কি আছে?
আপনার কথা ভুলিয়া যাও।
পরের কারণে মরণেও সুখ,
‘সুখ’ ‘সুখ’ করি কেঁদো না আর,
যতই কাঁদিবে, যতই ভাবিবে,
ততই বাড়িবে হৃদয়-ভার।
(সুখ- কামিনী রায়)
উদাহরণস্বরূপ, ব্যক্তিজীবনে আপনার সুখী হবার লক্ষ্যে যা যা প্রত্যাশা বা চাহিদা সেগুলো পূরণ করবার মতো সক্ষমতা ও সাধ্য আপনার রয়েছে। কিন্তু সুখ বাস্তবায়ন করতে, উপভোগ করতে আপনার যে উপার্জন, আপনার যে উদ্যোগ-আয়োজন, অপরাপর ব্যক্তি, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রীয় তরফ হতে সেগুলোর নিরাপত্তা বিধান করা যাচ্ছে না, আপনি শারীরিক ও মানসিক নিরাপত্তাহীনতা ভুগছেন, আপনার প্রতিবেশী, আপনার পরিবেশ আপনার জন্য প্রতিকূল। কিন্তু আপনি কোথাও আপনার প্রতি সংঘটিত অন্যায়-অবিচারের প্রতিকার চাইতে পারছেন না কিংবা ভরসা পাচ্ছেন না যে, আপনি আদৌ কোনো প্রতিকার বা ন্যায়বিচার পাবেন। তাহলে আপনার সিন্দুকভর্তি অর্থ, বাড়িভর্তি দেশি-বিদেশি দামি আসবাব, সরঞ্জাম, সাজসজ্জা, গ্যারেজভর্তি গাড়ি থাকলেও আপনি কিন্তু সুখী হতে পারবেন না। কিংবা সব ঠিকঠাক আছে আপনার জীবনসঙ্গীর সাথে আপনার বনিবনা হচ্ছে না, কিংবা আপনার সন্তান বিপথগামী- আপনার সুখ তখন কোথায়!
সুখের একটি অনন্য আত্মিক বা আধ্যাত্মিক শর্ত হলো মানসিক শান্তি। সুখ আর শান্তির মধ্যে এটাই মূল তফাৎ। সুখ অনুভূতির বিষয় হলেও তা প্রদর্শনযোগ্যও বটে। অর্থাৎ আপনি মানুষকে, সমাজকে বাহ্যিক আচারে, বহিরাঙ্গিকে, বাহ্যত দেখাতে পারেন যে আপনি সুখী মানুষ। সুখের অভিনয় করা যায়, সুখী মানুষের ভান ধরা যায়। কিন্তু এমন প্রায়শই হতে পারে অভ্যন্তরীণভাবে কার্যত আপনি অসুখী, কারণ সব সত্ত্বেও কোথা না কোথাও আপনার শান্তির তানপুরার তান নষ্ট হয়ে আছে। শান্তি ছাড়া সুখ অভিনয়। প্রকৃত সুখের জন্য অন্তঃস্থ বা আত্মিক ও বহিঃস্থ বা লৌকিক উভয় প্রকার শান্তিই আবশ্যক। কেননা শান্তি আত্মনিয়ন্ত্রিত হতে পারে কিংবা বহিঃস্থ নিয়ামক দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে।
শুধু ফিনল্যান্ড নয়, বরং স্ক্যান্ডিনেভিয়ান এবং তার আশপাশের দেশগুলো বিশ্বের সুখী দেশের তালিকায় সবসময় উপরের দিকেই থাকছে। এর কারণ কী হতে পারে? সেখানকার গবেষক, মনোবিজ্ঞানীরা (যেমন, ফিনল্যান্ডের হেলসিংকি ইউনিভার্সিটির সুখবিষয়ক গবেষক জেনিফার ডি পাওলা, ফিনল্যান্ডের মনোবিদ ও সুখগবেষক ফ্রাঙ্ক মারটেলা প্রমুখ) কিছু ব্যক্তিগত বা সমাজগত বৈশিষ্ট্যের কথা উল্লেখ করেছেন। ফিনল্যান্ডের অধিবাসীদের ব্যাপারে বলা হয়, তারা বিশ্বাস এবং চর্চা করে যে, সুখ কোনো প্রদর্শনযোগ্য বা প্রতিযোগিতার বিষয় নয়। যার যার সুখ তার তার একান্ত নিজস্ব। তাই সাধারণত সেখানকার মিলিওনিয়ারদের গ্যারেজভর্তি গাড়ি থাকতে দেখা যায় না। বরং তারা অন্য আর দশজনের মতো সাধারণ গাড়ি, সাইকেল বা গণপরিবহনও ব্যবহার করে থাকেন। তারা সামাজিকভাবে প্রতিযোগিতা বা প্রতিদ্বদন্দ্বিতা নয় বরং পারষ্পরিক সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতার মূল্যবোধ লালন ও চর্চা করে থাকে। অন্যের সুখ দেখে ঈর্ষাকাতর হয় না, তারা পরশ্রীকাতর জাতি নয়। তারা মনে করে আজকে যার দুর্দিন, তারও একদিন সুদিন আসবে। তাই হতাশ বা বিচলিত হবার কোনো কারণ নাই। এতো গেল ব্যক্তি পরিমন্ডলের কথা।
তাদের ব্যক্তিজীবনে এতটা সুখবিলাসী, উদারমনা, সহিষ্ণু হবার পিছনে সামাজিক বা রাষ্ট্রিক পরিমন্ডলের ভূমিকাও অপরিসীম ও অনস্বীকার্য। তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামো হচ্ছে কল্যাণমূলক কাঠামো। তাদের যাবতীয় মৌলিক চাহিদা পূরণের ভার আক্ষরিক এবং প্রকৃত কার্যকর অর্থে রাষ্ট্রই গ্রহণ করে। তাদের কল্যাণমূলক এই কাঠামো বৈষ্যম্যহীন। অর্থাৎ একজন সাধারণ নাগরিকের সন্তান যে বিদ্যালয়ে যে শিক্ষা, যে হাসপাতালে যে চিকিৎসা গ্রহণ করবে একজন কোটিপতির সন্তানের বেলাতেও তা-ই। অতএব নাগরিকদের মধ্যে ছোটবেলা হতেই পারষ্পরিক সৌহার্দ্য, ভ্রাতৃত্ববোধ, সহযোগী মনোভাব, সমজাতীয় ও সমস্বভাবের উদার মন-মানসিকতা গড়ে উঠে। রাষ্ট্র নাগরিকের ভরণপোষণ, কর্মসংস্থানের দায়িত্ব গ্রহণ করছে, কর্মহীন নাগরিকদের দায়িত্বও সে গ্রহণ করছে। পরিপূর্ণ স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক প্রশাসনিক কাঠামোতে তাদের সমাজে দুর্নীতির মাত্রা খুবই খুবই কম। আসলে যেখানে কোনো কিছুর প্রয়োজন থাকে না, ব্যক্তির সকল চাহিদার ক্ষেত্রেই পূরণের নিশ্চয়তা থাকে, সেখানে দুর্নীতির কোনো প্রয়োজনই থাকে না। তারপর যেটুকু থাকে, সেটুকু হলো লোভ। তবে আবার সুষ্ঠু বিচারব্যবস্থার কারণে এরকম ঘটনার ত্বরিৎ সঠিক ও ন্যয়বিচার হয়ে থাকে। কোনো অন্যায় বা বৈষম্যের শিকার ভুক্তভোগী ব্যক্তি যথাসময়ে প্রতিকার পেয়ে যান, রাষ্ট্র কর্তৃক ক্ষতিপূরণ প্রাপ্ত হন। তাহলে এ ধরনের রাজনৈতিক স্থিরতার একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র ও সমাজ কাঠামোতে মানুষের কোনো কিছু নিয়ে উদ্বিগ্ন, অস্থির, পেরেশান থাকতে হয় না। এর ফলে যে মানসিক নিশ্চিন্ততা ও শান্তি তারা উপভোগ করে তারই দৃশ্যমান প্রকাশ হলো সুখ। কারও সাথে কারও কোনো বিষয়ে কোনো দ্বন্দ্ব-বিবাদ, ঝগড়া-ফ্যাসাদ, প্রতিযোগিতা-প্রতিদ্বন্দ্বিতা নেই। আসলে তাদের এগুলোর প্রয়োজনও নেই।
এই যে তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কাঠামোর পরিচিতি উপস্থাপন করা হলো এটিই বহুল আলোচিত সুশাসনের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কাজেই একজন ব্যক্তি সুখ অনুভব করবে কি না, তা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নিয়ামকের সাথে সাথে সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামোর চরিত্রের উপরও অপরিহার্যভাবে নির্ভর করে। সমাজ ও রাষ্ট্রকাঠামো ব্যক্তির উপর তার সেই প্রভাবকে বহুল আলোচিত কল্যাণ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন বাস্তবায়নের মাধ্যমে কার্যকর করে।
তাহলে সুখী দেশের তালিকায় আমাদের দেশের ক্রমাবনতির কারণ সহজেই অনুমান করা যায়। সহজ কথায়, আমরা ব্যক্তি হিসাবে সুখে থাকতে চাইলেও রাষ্ট্রযন্ত্র ও তার পরিচালকদের চরিত্রের কারণে অনেকাংশেই তা সম্ভব হচ্ছে না। কল্যাণরাষ্ট্র নামক গরুটি রাষ্ট্র নামক কাজীর কিতাবে আছে, নাগরিক জীবনব্যবস্থার গোয়ালে নাই। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রের মূল যে পুষ্টি- সুশাসন, সেটিও শ্লোগানেই কেবল বন্দী। তাই আমাদের রাষ্ট্র অপুষ্টিতে ভুগছে, সমাজও রুগ্ন। সমাজে ও নাগরিক জীবনে আপাদমস্তক আদ্যোপান্ত অস্থিরতা, উদ্বেগ, উৎকন্ঠায় ঠাসা। যেখানে একজন নাগরিককে ঘরেবাইরে সার্বক্ষণিক দৈহিক, মানসিক, সামাজিক ঘোরতর অনিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা শংকায় দিনাতিপাত করতে হয় সেখানে তার জীবনে সুখ প্রবেশ করার কোনো ছিদ্রও অবশেষ থাকে না। এধরনের পরিবেশে নাগরিকরা সৈয়দ মুজতবা আলীর ভাষায় “কোনোমতে জীবন ধারণ করিয়া” বেঁচে থাকে মাত্র।
EIU (Economic Intelligence Unit) Democracy Index এর একটি কমপোনেন্ট হলো Political Participation Score । এই স্কোরে নাকি বিবেচনা করা হয়- ১) নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি (Voter turnout), ২) রাজনৈতিক কার্যক্রম (Political activism), ৩) রাজনৈতিক সংগঠনে সদস্যভুক্তি (Membership in political organizations), ৪) রাজনৈতিক আলোচনায় সংশ্লিষ্টতা ও অংশগ্রহণ (Engagement in political discussions), ৫) স্থানীয় শাসনব্যবস্থায় অংশগ্রহণ (Participation in local governance), ৬) রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও ভূমিকা (Women’s participation in politics), ৭) নাগরিক শিক্ষা ও সচেতনতা (Civic education and awareness)। আমি বিস্ময় ও অবিশ্বাসের সাথে লক্ষ্য করলাম, EIU Democracy Index এর Political Participation Score এ অতি রাজনীতি-সচেতন মানুষের দেশ বাংলাদেশের স্কোর ১০ এর মধ্যে মাত্র ৫, যেখানে নরডিক ও স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর এ স্কোর ১০ বা এর কাছাকাছি। যে দেশের মানুষ চা-দোকান হতে শুরু করে শোবার ঘর পর্যন্ত রাজনীতি নিয়ে নিত্য উন্মত্ত, সেখানে Political Participation Score এ বিবেচ্য বিষয়গুলোর প্রত্যেকটিতেই আমার হিসাবে বাঙালির বোনাস স্কোর করা উচিত।
সারকথা হলো, সুখ সরাসরি মানুষের মানসিক প্রশান্তির সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত। মানসিক প্রশান্তি ব্যতীত সুখ সোনার পাথর বাটি। ব্যক্তিগত পরিমন্ডলে সুখ একজন মানুষের ব্যক্তিগত চাহিদা, প্রত্যাশা ও নিজস্ব অর্জনের উপর নির্ভরশীল। তবে মানুষ প্রকৃত বিচারে কতটুকু সুখী হবে তা অনুভব ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে মানুষের নিজস্ব অর্জন এবং অনুভূতির পাশাপাশি এগুলোর উপর সমাজ ও রাষ্ট্রের অপরিহার্য প্রত্যক্ষ ও কার্যকর প্রভাব রয়েছে। আর রাষ্ট্র ও সমাজের এই প্রভাবের ভূমিকা ও কার্যকারিতা নির্ণয় করে সে ব্যক্তির মানসিক প্রশান্তির ব্যাপ্তি ও গভীরতা অর্থাৎ সুখানুভূতির মূল্যায়ন।
সর্বশেষ
সর্বশেষ, রাজধানী, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ, খেলাধুলা,
সর্বশেষ, রাজধানী, রাজনীতি, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, রাজধানী, রাজনীতি, অপরাধ, বিশেষ সংবাদ,
সম্পর্কিত খবর
সর্বশেষ, রাজধানী, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ, খেলাধুলা,
সর্বশেষ, রাজধানী, রাজনীতি, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, রাজধানী, রাজনীতি, অপরাধ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, রাজনীতি, অপরাধ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, রাজনীতি, বিশেষ সংবাদ, আন্তর্জাতিক,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, রাজধানী, রাজনীতি, অপরাধ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, অপরাধ, বিশেষ সংবাদ,
সর্বশেষ, বিশেষ সংবাদ, বাংলাদেশ (বিভাগ), শিক্ষা,
সর্বশেষ, রাজধানী, বিশেষ সংবাদ, লাইফস্টাইল, বিনোদন,